২৪ জুন, ১৯৮৭, রোজারিও। হোরাসিও মেসি নামের ভদ্রলোক ইস্পাত কারখানায় কাজ করতে ব্যস্ত। দরদর করে ঘামছেন কিন্তু মনে অন্য চিন্তা। ঘরে গর্ভবতী স্...
২৪ জুন, ১৯৮৭, রোজারিও। হোরাসিও মেসি নামের ভদ্রলোক ইস্পাত কারখানায় কাজ করতে ব্যস্ত। দরদর করে ঘামছেন কিন্তু মনে অন্য চিন্তা। ঘরে গর্ভবতী স্ত্রী, নতুন মুখের আগমনের সম্ভাবনায় আনন্দিত, চিন্তিতও খানিকটা। অভাবের সংসার এর ভিতরে নতুন মুখ!! বিকেলের দিকেই ঘরে ফিরে এলেন হোরাসিও মেসি। সন্ধ্যার একটু আগে সূর্য যখন ডুবি ডুবি করছে, ফুটবল বিশ্বের অন্যতম সূর্যের উদয়টা ঠিক তখনই হলো। নবজাতক এসেছে ঘরে, নবজাতকের কান্নায় বাবা ভুলেই গেলেন দারিদ্রতার কথা, অভাবের কথা।কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিয়ে স্বাগত জানালেন সদ্য জন্ম নেয়া পুত্র সন্তানটাকে। নাম রাখলেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি, আদর করে লিও।
ছোট্ট লিও আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছেন। বাবা-মা একটু একটু করে কাজে পাঠানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু ৫ বছর বয়সী লিওর কাজে কোন মন নেই। তার ধ্যান জ্ঞান সবই ঐ ফুটবলে। নিওয়েল’স ওল্ড বয়েজের গ্যালারী ছাড়া মাঠে সারাদিন দৌড়োতো ফুটবল নিয়ে। বয়সে বড় বড়, দানবের মত দেখতে সব ছেলেদের পাশ কাটাতো চকিতে। এক ভবিষ্যৎ কিংবদন্তীর শুরুর দিনগুলো কাটছিল ভালভাবেই। হঠাৎই ধরা পড়লো এক কঠিন রোগ। 'গ্রোথ হরমোন' এর অপর্যাপ্ততায় ভুগছেন লিও। রিভার প্লেট নামক এক ক্লাব লিওকে কিনতে চাইলেও তাদের সামর্থ্য ছিলোনা লিওর প্রতি মাসের চিকিৎসা খরচ ৯০০ ইউএস ডলার বহন করার। তবে কি থেমে যাবে লিওর বল পায়ে দৌড়োদৌড়ি? থেমে যাবে কাটিয়ে আনা বলগুলো ডি-বক্সের সামনে এসে হঠাৎই?
'টিস্যু পেপার' চিনেন? হুম, 'টিস্যু পেপার'। বার্সেলোনা ক্লাবের পরিচালক কার্লেস রেক্সাচ মাঠে বসে জাদু দেখেছিলেন বোধহয়। ম্যাচ শেষ হতে সময় নেননি। কাগজ পাচ্ছিলেন না, মরুকগে! আমার জাদুকরকে চাই, জাদুকর জনকের সাথে ম্যাচের মাঝেই তাই 'টিস্যু পেপার'এর মাঝেই চুক্তি করে নেন। জাদুকরের চিকিৎসার সকল দায়িত্ব বহন করবে ক্লাব বার্সেলোনা। ব্যস, জাদুকর বাবাকে সাথে নিয়ে পাড়ি জমালো বার্সেলোনা শহরে। তাঁরই দেশের কিংবদন্তী ম্যারাডোনা খেলে গেছেন যেখানে। শুরু হলো জাদুকরের বার্সেলোনা অধ্যায়। নিওয়েল’স ওল্ড বয়েজের লিওনেল মেসি হয়ে গেলেন 'লা মাসিয়া'র ছাত্র।
আর্থিক জটিলতায় একবার মেসিকে বেচে দেয়ার কথা উঠেছিল। কি করবেন? কি করবেন? ভাবতে ভাবতে বার্সেলোনা কর্মকর্তাদের গলঘর্দম অবস্থা। শেষ পর্যন্ত মেসিকে রেখে দেয়াই চুড়ান্ত হলো, বেচে দেয়া হলো লা মাসিয়ায় মেসিরই সবচেয়ে কাছের বন্ধু সেস্ক ফেব্রিগাসকে। নিন্দুকের নিন্দা, সমালোচনা সব সয়ে মেসি রয়ে গেলেন বার্সেলোনায়। কেন রেখে দিলেন এই ছেলেকে উত্তর পেতে ২০০৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন বার্সা কর্তৃপক্ষ।
২০০৪ সালের ১৬ই অক্টোবর বার্সেলোনার তৃতীয় সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে মাঠে নামলেন জাদুকর। রোনালদিনেহোর বাড়িয়ে দেয়া বলটাকে অসাধারণভাবে জালে জড়িয়ে বিশ্ব ফুটবলকে হয়তো জানানই দিলেন 'আমি এসে গেছি'। এরপর তো ইতিহাস। একের পর এক গোলে নিন্দুকদের বুঝালেন তাকে এমনি এমনি রেখে দেয়া হয়নি, পায়ের জাদুতেই টিকে ছিলেন তিনি।
ক্লাব তো অনেক হলো ঐ রোজারিওর ঋণ চুকাতে তো হবে। ২০০৫ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে মাঠে নামেন জাদুকর। 'এলাম, দেখলাম, জয় করলাম' ভঙ্গীতে ছ'ছটি গোল করে আর্জেন্টিনাকে কাপ তো জেতালেনই সাথে টুর্নামেন্ট সেরার পুরষ্কার বগলদাবা করে ফিরলেন বুয়েন্স আয়ার্সে, উল্লাসে মাতলেন জন্মভুমি রোজারিওতে। নিন্দুকেরা ভোল পালটে বলতে লাগলো 'আরে, এতো সাক্ষাৎ ম্যারাডোনা'।
'ম্যারাডোনা' খেতাব যেন উসকে দিলো লিওকে। আগুনে যেন বারুদ পড়লো। বিশ্ব ভুলবেনা ২০০৭ সালের ১৮ এপ্রিলের দিনটাকে, গেটাফে তো আরও নয়। মাঠের ডানদিক থেকে আচমকা দৌড় শুরু জাদুকরের। ৬ জন খেলোয়াড় মিলে থামাতে পারলোনা সে দৌড়কে থামানো যখন গেলো তখন বলটাকে দেখা গেলো জালে খাবি খাচ্ছে আর জাদুকরকে দেখা গেলো কর্নার পয়েন্টে উদযাপনে ব্যস্ত ভুমিকায়। ইতিহাসের পাতা উল্টাতে ব্যস্ত সবাই, এমন গোল এর আগে আর কোথাও দেখা গিয়েছে? খোঁজ! খোঁজ! খোঁজ! হ্যাঁ, ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐ ডান প্রান্ত থেকেই ছ'জনকে কাটিয়ে জালে ঠেলেছিলেন বল। অবাক এই মিল পেয়ে স্প্যানিশ পত্রিকাগুলো নামই মিলিয়ে ফেললো। 'মেসিডোনা' নামে ডাকা হলো লিওকে। ২০০৯ সালে ব্যালন ডি'অর পুরষ্কার জেতেন ফুটবলের ছোট্ট জাদুকর, এরপর আর থামেননি, টানা চারবার ব্যালন ডি'অর জিতে দুনিয়াকে জানিয়ে দেন 'আমি মেসি, আমিই সেরা'। এটলেটিকো মাদ্রিদের সাথে এক ম্যাচে গোল করার পর তো ধারাভাষ্যকার 'রে হাডসন' বলেই উঠেন " এ ছেলে এ গ্রহের নয়, অন্য গ্রহ থেকে এসেছে। পৃথিবীর কেউ এরকম গোল করতে পারেন না।"
ক্লাব ফুটবলের অন্যন্য মেসি কিন্তু জাতীয় দলে গেলে কি হয় তার? গোলই পান না। তবে কি জাতীয় দল খেলে বিরক্ত মেসি, জাতীয় দলে কোন আগ্রহই কি নেই মেসির? উত্তর আসলো স্পেইন থেকে। স্পেইন এর নাগরিত্ব দিয়েই শুধু ক্ষান্ত হননি স্পেইনবাসীরা, মেসিকে স্পেইন জাতীয় দলে খেলার প্রস্তাবও দেয়া হলো। কন্ঠে দৃঢ়তা, আর মনে প্রবল দেশপ্রেম নিয়ে মেসি বলেন 'আমি আর্জেন্টিনায় জন্মগ্রহন করেছি, আর্জেন্টিনার হয়ে খেলতে পেরে আমি গর্ববোধ করি'। ২০০৬ এর বিশ্বকাপে প্রথম বিশ্বকাপ খেলছিলেন মেসি। সার্বিয়া-মন্টিনিগ্রোর সাথে ঐ ম্যাচে বিশ্বকাপে একমাত্র গোলটি করেছিলেন মেসি। তারপর?
তারপর ৮ বছরের অপেক্ষা। ২০১০ এর বিশ্বকাপে প্রত্যাশার চাপ নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে সাউথ আফ্রিকায় যান মেসি। সবাই অপেক্ষায়, ২৪ বছরের আক্ষেপ ঘুচাবে লিও, পায়ের জাদুতে আর্জেন্টিনাকে ভাসাবে বিশ্বকাপ জেতার আনন্দে। কিন্তু না, জার্মানীর কাছে বাজেভাবে হেরে আক্ষেপটা বাড়ালেনই মেসি, তবে কি ফুরিয়ে গেছেন মেসি? নাহ! সংবদ্ধ চোয়াল, দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিজ্ঞা করলেন আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতাবেনই। ২০১৪ তে ব্রাজিলে আসলেন। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার সাথে ম্যাচের শুরুতে কিছুটা নিষ্প্রভ জাদুকর। হঠাৎ করে বিপক্ষ দলের তিনজনকে অবাক করে দিয়ে জালে বল ঠেলে শুরু করলেন বুনো উদযাপন, করবেনই না কেন? ৮ বছরের অপেক্ষা শেষ। পাগল হয়ে গিয়েছিলেন লিও। উল্লাস থামলো একেবারে ফাইনালে যেয়ে। সেমিফাইনালে জিতে স্বপ্নের ফাইনালে যাওয়ার পথে কেঁদেছিলেন জাদুকর। আবেগ আর চাপা দিয়ে রাখতে পারেন নি। কিন্তু ফাইনালে বাঁধ সাধে হিটলারের ঐ জার্মানি। ১১৩ মিনিটে ঐ গোতজের ঐ গোল চুপসে দেয় জাদুকর মেসিকে, পুরো পৃথিবী জুড়ে থাকা তার হাজার হাজার অগণিত ভক্তকে। নাহ, ফাইনাল হেরে আর কাঁদেননি। সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার নিতে গিয়ে হঠাৎ থমকে এক নজরে চেয়েছিলেন কাপটার দিকে। যেন বলছিলেন, তুমি আসবে একদিন, আমার হাতে তোমাকে আসতেই হবে।
যদি সত্যিই বলে থাকেন, তবে ভুল বলেননি জাদুকর। বিশ্বকাপটা যে পরিপূর্ণ নয় জাদুকরের ঐ হাতের ছোঁয়া পাওয়ার আগে। ব্যালন ডি'অর, ক্লাব ফুটবলের এত এত রেকর্ড, অগণিত পুরষ্কারে ভর্তি জাদুকরের ট্রফি ক্যাবিনেটটা ঐ কাপ আসার আগে পরিপূর্ণ নয় জাদুকর নিজেও জানেন। ২০১৮ তে তাই তৈরী হচ্ছেন, কাপ ছোঁবেন, সেরা খেলোয়াড় বিতর্কের অবসান হয়তোবা সেদিনই ঘটবে।
আচ্ছা এতগুলো কথা কেন লিখলাম? আদৌ কি জাদুকরের সব কথা লিখতে পারলাম? সম্ভবই নয়। এত বড় মহারথীর কথা এই দুই-এক লাইনে লেখার মত যোগ্যতা আমার তো নেইই, বোধহয় কারোরই নেই। তবুও এনাকে নিয়ে লিখলাম। এই ২৪ এ জুনেই ১৯৮৭ সালে জন্মেছিলেন এই ছোট্ট জাদুকর। উচ্চতায় মাত্র ৫'৭" ইঞ্চি, কিন্তু তার ফুটবলীয় উচ্চতা এমন এক জায়গায় তিনি নিয়ে গেছেন যে তিনি ছাড়া আর কেউ ছুঁতেই পারবেন না। তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো হয়তো আক্ষেপ করেনই মাঝে মাঝে 'কেন যে এই যুগটাতে জন্মালাম?' হ্যাঁ, রোনাল্ডো আপনার আক্ষেপ করা উচিৎ ইনি না থাকলে আপনার সেরা হওয়া ঠেকাতে পারতোনা কেউই। আক্ষেপের সাথে আপনার স্বস্তিটা হলো, আপনি ইতিহাসে অন্যতম সেরা ফুটবলারটার খেলা নিজ চোখে দেখছেন, জাদুকরটা আপনার প্রতিপক্ষ। গর্ব আপনি করতেই পারেন মিঃ সি আর সেভেন।
শুভ জন্মদিন লিওনেল মেসি। শুভ জন্মদিন জাদুকর। শুভ জন্মদিন থিয়াগোর বাবা। আজকের দিনটা আপনার জন্যই সবাই মনে রাখছে। ২০১৮ তে বিশ্বকাপ উঁচিয়ে আজকের দিনটা যেন শত বছর ধরে সবাই মনে রাখে সে ব্যবস্থাই করুন। তবে এ জন্মদিনে ভক্তদের উপহার হিসেবে কোপা আমেরিকার কাপটা উঁচিয়ে ধরতেই পারেন জাদুকর।
অনেক অনেক শুভ কামনা লিও মেসি। ঐ দিনটার অপেক্ষায় আমরা জানি আপনিও যেদিন পুরো বিশ্ব মাতবে 'মেসি-বন্দনায়'। যেদিন বিশ্ব জয় করে কোন এক অলস সন্ধ্যায় আপনি বাড়ি ফিরবেন শুধুই থিয়াগোর বাবা 'মেসি' হিসেবে, রোকুজজ্জোর স্বামী 'মেসি' হিসেবে, মা মারিয়ার আদরের 'মেসি' হয়ে আর কানে বাজবে 'জয়তু মেসি, তুমিই সেরা, ধন্যবাদ'।
ক্রেডিটঃ
ফাইয়াদ বিন খালিদ
২৪/০৬/২০১৫
COMMENTS